রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে বহু জীবন, নিঃশেষ হয়ে গেছে অনেক স্বপ্ন। এ ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা গেছে একাধিক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। কেউ এখনো নিখোঁজ, কেউবা হারিয়েছে আপনজনকে।
ছোট্ট সাহসী শামীম আর নেই
সারা শরীরে ব্যান্ডেজে ঢাকা, আইসিইউতে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আবদুল্লাহ শামীম। ৯৫ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়েও সাহস হারায়নি সে। বড় বোন ফারজানা কনিকাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার শরীর কি অনেক পুড়েছে, আপু? বোন তাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘না ভাইয়া, তুমি ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু সেই সাহসী কিশোর আর ফিরেনি। সোমবার (২১ জুলাই) রাতে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়।
শামীম দগ্ধ হওয়ার পর নিজেই হেঁটে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর সদস্যদের কাছে সাহায্য চাইতে। চিকিৎসকদের নিজের পরিবারের নম্বর দিয়েছিল—সেই কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বোন ফারজানা।
নিখোঁজ স্ত্রীর খোঁজে স্বামী
মঙ্গলবার সকালে জাতীয় বার্ন ইউনিটের সামনে দাঁড়িয়ে সাহায্যের আকুতি জানাচ্ছিলেন আমিনুল ইসলাম জনি। বলছিলেন,
‘আমি আমার স্ত্রীকে খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ যদি সাহায্য করেন। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের খবর শুনে তার স্ত্রী লামিয়া আক্তার সোনিয়া ছুটে গিয়েছিলেন মাইলস্টোন স্কুলে, যেখানে পড়াশোনা করে তাদের মেয়ে জায়রা। মেয়েকে একজন অচেনা মানুষ উদ্ধার করলেও এখনো স্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। শুধু একটি পোড়া জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
পাওয়া গেল রাইসা মনির লাশ
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী রাইসা মনি নিখোঁজ ছিল বিধ্বস্তের পর থেকে। বহু খোঁজাখুঁজির পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিএমএইচে পাওয়া গেছে তার নিথর দেহ। বাবা নিজেই শনাক্ত করেছেন মেয়ের লাশ। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার ছোট্ট রাইসা আর কখনো ফিরে আসবে না তার গ্রামের বাড়িতে।
একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় শিক্ষক দম্পতি
আরেক মর্মান্তিক ঘটনা রাঙামাটির উক্য সাইন মারমাকে ঘিরে। সপ্তম শ্রেণির এই শিক্ষার্থী বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার রাতে মারা যায়। তার বাবা-মা দুজনেই শিক্ষক। একমাত্র সন্তান ছিল উক্য। সন্তান হারিয়ে নির্বাক হয়ে গেছেন তারা।
ছেলেকে পাওয়া গেল, মাকে নয়
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আফসান ওহীকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেলেও তার মা আফসানা প্রিয়া এখনো নিখোঁজ। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের সময় ছেলেকে নিয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন তিনি। সন্তান ফিরে এলেও আর খোঁজ মেলেনি মায়ের। এখনো স্বজনরা খুঁজে ফিরছেন তার সন্ধান।
হাজার রাতের চেয়ে দীর্ঘ এক রাত
বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে ভিড় করেছিলেন স্বজনরা। কারও হাতে ছেঁড়া পোশাক, কারও হাতে শিশুর স্কুলব্যাগ—সবাই প্রিয়জনকে খুঁজছেন, শনাক্ত করতে চান এক টুকরো স্মৃতি দিয়ে। কেউ পাননি, কেউ পেয়েছেন দগ্ধ লাশ।
এই দুর্ঘটনা কেবল কিছু প্রাণ কেড়ে নেয়নি, ছিন্ন করেছে বহু পরিবারের সুখের জাল। আরেকটি যুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তারা প্রিয়জন হারানোর শূন্যতা মেনে নেওয়ার যুদ্ধ।