ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলন দমনে সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনার বিষয়টি এখন তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কে শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিশ্বস্ত দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ বাস্তবায়নের মূল দায়িত্বে ছিলেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা তানভীর হাসান সৈকত।
সরকার পতনের পর আত্মগোপনে যাওয়া এই তিনজন গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে সাতটি মোবাইল ফোন জব্দ করে তদন্ত সংস্থা। ইতোমধ্যে এসব ফোন ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ডিজিটাল ক্রাইম ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এই ফোনগুলোর ফরেনসিক রিপোর্টেই মিলতে পারে ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের মূল নির্দেশনার প্রমাণ।
জব্দ ফোনের তালিকায় রয়েছে পলকের ব্যবহৃত একটি আইফোন ১৫ প্রো ও দুটি স্যামসাং এস২৪ আল্ট্রা, টুকুর একটি নোকিয়া বাটন ফোন ও একটি স্যামসাং গ্যালাক্সি এম১৪ এবং সৈকতের একটি আইফোন ও একটি ডোকোমো ৫জি ফোনসেট। পুলিশ বলছে, গ্রেফতারের আগে পরিকল্পিতভাবে ফোনের সকল তথ্য মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে ফরেনসিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মুছে ফেলা বার্তা, কল রেকর্ড, মিডিয়া ফাইল এবং অ্যাপের গোপন চ্যাট উদ্ধার করার কাজ চলছে।
মামলার নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, গত বছরের ২০ জুলাই পল্টন থানায় দায়ের হওয়া রিকশাচালক কামাল মিয়া হত্যা মামলায় এই ফোনগুলো জব্দ দেখানো হয়। আদালতের নির্দেশনায় ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য ফোনগুলো পাঠানো হয় যাতে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য পরিকল্পনা, আদেশ-নির্দেশ, বার্তা এবং সংশ্লিষ্টতার পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রকাশ্যে আসে।
বিশ্বস্ত সূত্রগুলো জানিয়েছে, আন্দোলন দমন করতে শেখ হাসিনা একের পর এক ফোন ও গোপন বার্তা পাঠান। পলক, টুকু ও সৈকতের মাধ্যমে তিনি ইন্টারনেট বন্ধ, বিশেষ অভিযান এবং সর্বশেষ গুলির নির্দেশনা দেন। এসব যোগাযোগে হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, টেলিগ্রাম, ভাইবার, এমনকি ই-মেইলের মতো নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। মাঠ পর্যায়ে ইন্টারনেট শাটডাউন এবং নিরস্ত্র জনতার ওপর নির্বিচারে গুলির মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলে অভিযোগ উঠেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আসামিরা শুধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত নন, তারা পুরো পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ফরেনসিক রিপোর্টে উদ্ধার হওয়া তথ্যেই প্রমাণিত হবে, কার নির্দেশে এবং কীভাবে এই নিষ্ঠুর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল।
গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ইন্সপেক্টর ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহেল বাকী বলেন, এটি একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর তদন্ত। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ফরেনসিক পরীক্ষা চলছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর চার্জশিটে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে।
বিশেষ প্রসিকিউশন টিমের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজি বলেন, এই মামলার অন্যতম নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হবে ডিজিটাল ফরেনসিক রিপোর্ট। যদি এগুলোতে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের আলামত পাওয়া যায়, তবে আদালতে তা ম্যাটেরিয়াল ফ্যাক্ট হিসেবে বিবেচিত হবে। বিচারের গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন করবে এই তথ্য।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২২ সালের এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী ডিজিটাল তথ্য এবং মুছে ফেলা বার্তাও প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। ফলে, ফরেনসিক রিপোর্টে শেখ হাসিনার সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ উঠে এলে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ বিচারের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত হতে চলেছে।