দেশজুড়ে একইসঙ্গে ডেঙ্গু, করোনা ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ জনমনে নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। জ্বর এলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন মানুষ—ডেঙ্গু, করোনাভাইরাস,না-কি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত,তা বুঝে উঠতে পারছেন না অনেকেই। বিশেষত শিশুদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় অভিভাবকরা। কেউ মশারিতে আশ্রয় নিচ্ছেন,কেউ মশা নিধনে ব্যস্ত,আবার কেউ ব্যবহার করছেন মাস্ক।
চিকিৎসকদের মতে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন বয়স্ক নাগরিক,গর্ভবতী নারী,শিশু এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন বা যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম। তারা স্পষ্ট করে বলছেন—জ্বর হলেই অবহেলা নয়, দ্রুত চিকিৎসকের শরণ নেওয়া জরুরি।
ডেঙ্গুর বাড়বাড়ন্ত
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ৫৪৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। বরগুনাকে ইতোমধ্যে ‘রেড জোন’হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।আক্রান্তদের মধ্যে ৫৮.৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৪১.২ শতাংশ নারী।
আইইডিসিআরের তথ্যমতে, রাজধানীর দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টি ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি,অর্থাৎ প্রতি ১০০ পাত্রে ২০টির বেশি পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি লার্ভা মিলেছে ফুলের টব ও ড্রেনে জমে থাকা পানিতে—২৭ শতাংশ। এরপর রয়েছে পানির ট্যাংক (২২%),ফ্লোরে জমে থাকা পানি (২০%), ড্রাম (১৩%), লোহার পাইপ (১১%) এবং প্লাস্টিকের পাত্র (১০%)।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বর্ষাকালে (জুন-সেপ্টেম্বর) পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। চলতি বছরের থেমে থেমে বৃষ্টি এবং ভ্যাপসা গরম ডেঙ্গু বিস্তারে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে।
চিকুনগুনিয়া বাড়ছে নীরবে
চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সুনির্দিষ্ট তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। আইইডিসিআরের মতে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছর পর্যন্ত অনেক জ্বরের রোগীর শরীরে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়েছে। সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪৫ শতাংশ জ্বরের রোগী ছিলেন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত।
এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস প্রজাতির মশা চিকুনগুনিয়ার বাহক। গবেষকদের মতে, এই ভাইরাস ‘টোগা’ গোত্রের এবং আরবো ভাইরাস হিসেবে পরিচিত। ২০১৭ সালে দেশে চিকুনগুনিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছিল, তবে তৎকালীন রিপোর্টিং সিস্টেম না থাকায় প্রকৃত সংখ্যার হদিস মেলেনি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা,তখন অন্তত এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন।
করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ও প্রস্তুতি
চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৭৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা মহামারি শুরুর পর দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখ ৫২ হাজার ১৮ জন এবং মোট মৃত্যু ২৯ হাজার ৫১৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. আবু জাফর জানিয়েছেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে ফের সক্রিয় হয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে ১৭ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করা হয়েছে বিভিন্ন কেন্দ্রে। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলোতে পৌঁছে গেছে পরীক্ষার কিট।
তিন রোগের পার্থক্য
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু, করোনা ও চিকুনগুনিয়ার মধ্যে পাঁচটি মূল পার্থক্য লক্ষ করা যায়—
1. জ্বরের ধরন:
ডেঙ্গু: ১০২-১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট, ৪-৫ দিন
করোনা: ১০০-১০১ ডিগ্রি, ২-৭ দিন
চিকুনগুনিয়া: অল্প থেকে বেশি, ২-৪ দি
2. ব্যথা:
ডেঙ্গু: চোখের পেছনে, মাথা, শিরদাঁড়া, মাংশপেশী
করোনা: মাথা ও মাংশপেশীতে মাঝারি
চিকুনগুনিয়া: জয়েন্টে তীব্র ব্যথা
3. র্যাশ ও রক্তক্ষরণ:
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় দেখা যায়
করোনায় এই উপসর্গ নেই
4. বমি ও পাতলা পায়খানা:
ডেঙ্গু ও করোনায় হতে পারে
চিকুনগুনিয়ায় সাধারণত হয় না
5. রক্তচাপ হ্রাস ও অর্গান বিকল:
ডেঙ্গুতে প্রায় ৫০% রোগীর রক্তচাপ কমে যায়
করোনা ও চিকুনগুনিয়ায় এই ঝুঁকি কম